আভিজাত্যের প্রতীক দানবীর মৌলভী গোলাম খালেক চৌধুরী
প্রকাশিত : ০০:০৭, ১৪ জুলাই ২০১৮
শিক্ষিত সজ্জন, সমাজহিতৈষী, সর্বজন শ্রদ্ধেয় গোলাম খালেক চৌধুরী ব্যক্তিত্বে, বদান্যতায় বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। অখ্যাত পল্লীর প্রান্তরে মহিরুহের মতো ছিল তার সামাজিক অবস্থান। ‘উপকার কর এবং উপকৃত হও’- এ মহাজন বাক্য তার জীবন ও কর্মে, মনন ও মেধায় পথ চলা এবং জীবন সাধনায় স্বতঃসিদ্ধের মতো অর্থবহ ও কার্যকর ছিল।
মানুষকে সাহায্য করতে তার হস্ত ছিল সব সময় প্রসারিত। নির্দ্বিধায় অকাতরে দান করতেন প্রকাশ্যে এবং গোপনে। গরিব এবং ছিন্নমূলদের যাকে যেখানে সম্ভব হয়েছে বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। মানুষের চলাচলের জন্য নির্মাণ করে দিয়েছেন কয়েক কিলোমিটার রাস্তা। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় এবং ব্যবসায়ীদের ব্যবসার সুবিধার্থে তৈরী করে দিয়েছেন বাজার। নিজের এলাকার মানুষের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্মাণ করেছেন স্কুল। শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন বিশাল জায়গা।
সন্দ্বীপের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালে তিনি অকাতরে দান করেছেন। ইবাদত-বান্দেগীর জন্য তৈরী করেছেন মসজিদ। তখন দুরের স্বজনদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। এলাকার মানুষের এই প্রয়োজনটুকু উপলব্দি করে তৈরী করেছেন পোস্ট অফিস। মেধাবীদের দিয়েছেন বৃত্তি। জেলেদের থাকার জন্য নির্মান করেছেন বিশাল ‘জেলে পাড়া’। যাকে যেভাবে সম্ভব হয়েছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। পরোপকারী এই মানুষটি সন্দ্বীপের কৃতি সন্তান মৌলভী গোলাক খালেক চৌধুরী। সংক্ষেপে জিকে চৌধুরী। যাঁকে তৎকালীন বাংলার গভর্ণর লর্ড কার মাইকেল ‘Uncrowned Prince Of the Island’ উপাধি দেন।
তার জীবনযাপনে ছিল ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য। নবাবী স্টাইলে পোশাক পড়তেন জি.কে চৌধুরী। সৌখিন এই মানুষটির ব্যবহৃত পোশাক কোলকাতা থেকে ইস্ত্রি করে আনা হতো। তিনি ছিলেন ভোজন বিলাসী। কলকাতার বিখ্যাত সুগন্ধিযুক্ত মসলার তামাক ছিল জি.কে চৌধুরীর খুবই প্রিয়। ফুরিয়ে যাবার আগেই তিনি এর বন্দোবস্ত করে রাখতে ভুলতেন না। শোনা যায়, সন্দ্বীপে চা, পান ও গোশত-পরোটা খাওয়ার প্রচলন শুরু হয় এই জমিদার বাড়ি থেকেই।
বিশাল সম্পত্তির অধিকারী জি.কে চৌধুরী জমিদারির দেখভালের জন্য পালকি এবং ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতেন। গায়ের রং এবং আচরণের সাথে মিল রেখে ঘোড়ার নাম রাখেন তিনি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল -টমটম, দুর্বার, বিদ্রোহী, দুলদুল, বোরাক ও বুলবুলি। বছর শেষে খাজনা আদায়ের সময় নাচে-গানে, খাওয়া-দাওয়াসহ এক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরী হতো এই জমিদার বাড়িতে। চরিত্রের আরেকটি দিক ছিল তার অতিথি পরায়নতা। কলকাতা হতে তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কার মাইকেল সন্দ্বীপে সফরে আসলে মৌলভী গোলাম খালেক চৌধুরী তাকে লাল গালিচা সম্বর্ধনা দেন। ডাক বাংলায় সুসজ্জিত মঞ্চ সাজিয়ে লর্ডকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেন।
তৎকালীন কলকাতা বন্দরের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ছিলেন আহমেদ আলী চৌধুরী। আহমেদ আলী চৌধুরীর খাস সম্পত্তির পরিমান ছিল ৬৪ দোরন। তখনকার হিসাবে ১৬ কানিকে ১ দোরন বলা হতো। অর্থাৎ এই ডাকসাইটে জমিদারের ১০২৪ কানি সম্পত্তি ছিল। তৎকালীন সন্দ্বীপে আরও অনেক জমিদার ছিলেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আহমেদ আলী চৌধুরীর সন্তান গোলাম খালেক চৌধুরী। বাবা তার সুযোগ্য সন্তান জিকে চৌধুরীকে এই বিশাল সম্পত্তি, দুই আলমিরা ভর্তি মোহরের মালিকানা বুঝিয়ে দেন।
পিতার অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরুপে পালনের জন্য জি.কে চৌধুরী অসংখ্য মানুষ নিয়োগ দেন। তাদের মধ্যে আছে ধোপা, নাপিত, বেয়ারা (পালকি বহনকারী), কামার, কুমার, কবিরাজ, জেলেসহ আরও বিভিন্ন পেশার লোকজন। তাদের থাকা খাওয়ার সুবিধার জন্য তিনি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেন।
শোনা যায়, তিনি এক রাতে এক হাজার জেলে পরিবারের জন্য স্থায়ীভাবে থাকার বন্দোবস্ত করেন। যেখানে এখনও জেলেরা বসবাস করছে (মৌলভী বাজারের পূর্ব দিকে)। যেটি এখন জেলে পাড়া, স্থানীয় ভাষায় ‘জাইল্লা পাড়া’ নামে পরিচিত।
এদিকে এই বিশাল সম্পত্তির দেখভালের জন্য প্রায় ২৫০ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের রান্না বান্নার জন্য নিয়োজিত ছিল অসংখ্য দাস-দাসী-বাবুর্চি। মৌলভী গোলাম খালেক চৌধুরী ছোটবেলায় মাকে হারান। বাবার অতি আদরে বেড়ে ওঠা জি.কে চৌধুরী মায়ের অভাব খুব বেশি অনুভব করেননি। কলকাতায় বাবার সান্নিধ্যে থেকে অভিজাত পরিবেশে তিনি বাল্যকালের সূচনা করেন।
সন্তানের মেধা ও প্রখর বুদ্ধিমত্তা দেখে বাবা পুত্রের ভবিষ্যত নিয়ে এক সোনালী স্বপ্ন বুনেন। খোদাভীরু আহমেদ আলী চৌধুরী আরবী শিক্ষায় উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য জি.কে চৌধুরীকে তৎকালীন উপমহাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করান। বাবার স্বপ্ন পূরনে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। প্রতিটি শ্রেনীতে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে গোলাম খালেক চৌধুরী সর্বশেষ কামিল পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন।
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের অনুরোধে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। আরবী, ফার্সি ছাড়াও ইংরেজী ভাষায়ও পান্ডিত্য লাভ করেন জি.কে চৌধুরী। মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন গোলাম খালেক চৌধুরী। চলাচলের সুবিধার্থে পূর্ব বাউরিয়া ঘাট থেকে পশ্চিমে প্রায় সাত মাইল রাস্তা তারই উদ্যোগে নির্মান হয়। এছাড়াও নির্মান করেছেন মৌলভী বাজার, পোস্ট অফিস। ইবাদত বন্দেগীর জন্য নির্মান করেছেন জামে মসজিদ। যেটি মৌলভী বাজার জামে মসজিদ নামে পরিচিত।
শিক্ষিত, স্বজ্জন এবং দানশীল এই মানুষটির শিক্ষার প্রতি ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠা করেন বাউরিয়া জি.কে একাডেমী। যেটি এখন সন্দ্বীপে সর্বমহলে সুপরিচিত। এই স্কুল থেকে পড়াশোনা করে দেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় সন্দ্বীপের কৃতি সন্তানেরা তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন বিশাল জায়গা। যেটি এখন জিকে একাডেমীর স্কুল মাঠ হিসেবে পরিচিত। তিনি সন্দ্বীপ টাউন হল এবং ঐতিহ্যবাহী কার্গিল হাইস্কুলের জন্যও প্রচুর আর্থিক সাহায্য দেন। পাশাপাশি সাহায্য করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন করতেন জি.কে চৌধুরী। তারই ধারাবাহিকতায় কার্গিল হাই স্কুলে যে মুসলিম শিক্ষার্থী পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করতো তাকে তিনি বৃত্তি প্রদান করতেন যা বহু বছর ধরে প্রচলিত ছিল। এছাড়াও সন্দ্বীপ সরকারী হাসপাতালে একটি ওয়ার্ড নির্মাণ করেন এই দানবীর। এসবের মাঝে চিরভাস্বর হয়ে রইবে তাঁর স্মৃতি।
লেখক পরিচিতিঃ সাপ্তাহিক দ্বীপকথা সম্পাদক।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।